বাংলাদেশ ঠিক কবে সেক্যুলার রাষ্ট্র হবে?

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দুঃখজনকভাবে কখনই সেক্যুলারিজমের চর্চা করা হয়নি। এখানে নামেমাত্র সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখা হলেও সেটা আসলে জগাখিচুড়ি হয়ে গেছে।

0
30

প্রথমত আমাদের বুঝতে হবে সেক্যুলারিজম আসলে কি? এই বিষয়ে খুব চমৎকার যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে অভিজিৎ দা’র। তবে আমি সংক্ষেপে এখানে বলার চেষ্টা করছি।

সেক্যুলারিজম মানে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোন কাজে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবেনা। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখাটাই সেক্যুলারিজম। ধর্ম থাকবে যার যার ব্যক্তিগত কাজের পরিমণ্ডলে।

যেমন, কোন স্কুল ছাত্র যদি পরীক্ষা দিতে যায়, আর সে ইসলাম ধর্মের অনুসারী হলে তাহলে হয়তো ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পরীক্ষার খাতায় লেখার আগে বিসমিল্লা বলে লেখা শুরু করতেই পারে। এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু, কোন মন্ত্রী যদি সংসদে কোন বক্তব্য পাঠ করতে চান আর তার আগে বিসমিল্লা বলে ফেলেন তাহলে সেটা আর সেক্যুলারিজম রইলোনা। কারণ সংসদে বক্তব্য দেয়া রাষ্ট্রীয় কাজ, আর রাষ্ট্রীয় কাজ থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখাটাই সেক্যুলারিজম।

সেক্যুলারিজম সম্পর্কে অভিজিৎ দা’র অসামান্য ব্যাখ্যাটি এখান থেকে পড়ে নিতে পারেন।

পোষ্টের শিরোনামের প্রসঙ্গে আসা যাক। বাংলাদেশ আদৌ কোন সেক্যুলার রাষ্ট্র নয়। সেক্যুলারিজম চর্চার বিষয়। একটি রাষ্ট্র একদিনে হুট করে সেক্যুলার হয়ে উঠতে পারেনা। রাষ্ট্র হিসেবে সেক্যুলার হতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং চর্চার মধ্যে থাকতে হবে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দুঃখজনকভাবে কখনই সেক্যুলারিজমের চর্চা করা হয়নি। এখানে নামেমাত্র সংবিধানকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখা হলেও সেটা আসলে জগাখিচুড়ি হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটি বোঝানোর জন্য আমি অভিজিৎ দা’র লেখা থেকে তুলে দিচ্ছি।

“বেতারে, টেলিভিশনে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে – সর্বত্র কুরান শরীফ, গীতা, বাইবেল আর ত্রিপিটক পাঠ করা হতে লাগলো এক সংগে। এ আসলে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বরং ধর্ম আর শ্রদ্ধার মিশেল দেওয়া এক ধরণের জগাখিচুরি।”

অর্থ্যাৎ দেখা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্র ধর্ম থেকে আলাদা না হয়ে, রাষ্ট্র নিজেই সকল ধর্মচর্চার দায়িত্ব নিয়েছে। যেটা আসলে দিনকে দিন হিতে বিপরীত হয়েছে। আর একারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেন এভাবে

“ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া সহ্য করা হবেনা।”

অথচ ধর্মকে রক্ষার দায়িত্ব নেয়ার কথা রাষ্ট্রের ছিলোনা। রাষ্ট্রের উচিত ছিলো ধর্মের কারণে আক্রান্ত মানুষগুলোকে রক্ষা করা।

বাংলা একাডেমি ধর্মীয় সমালোচনামূলক বই লেখক এবং প্রকাশক দুজনকেই পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। অথচ ধর্মকে রক্ষার দায়িত্ব বাংলা একাডেমিকেও দেয়া হয়নি। বাংলা একাডেমিকে দেয়া হয়েছে বই রক্ষার দায়িত্ব।

মূলত দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্র ধর্মকে আলিঙ্গন করে সেক্যুলার হতে চাচ্ছে, যেটা কার্যত ভণ্ডামি। সকল ধর্মকে সমান মর্যাদা দিয়ে ধর্মকে রক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করার ভণ্ডামি রাষ্ট্র নিজেই করছে। রাষ্ট্র ধরেই নিয়েছে যে তাঁর সকল নাগরিক কোন না কোন ধর্মের অনুসারী, যেটাকে বলা যায় রাষ্ট্রের মূর্খামির পরিচয়।

রাষ্ট্র হিসেবে সেক্যুলার হয়ে উঠতে হলে উদ্যোগটা নিতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই। এখানেই আসছে শিক্ষার কথা। বলা হয়, “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।” কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি শিক্ষাকে দেখে বাণিজ্য হিসেবে। এখানে শিক্ষা মানে সার্টিফিকেট, যার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের স্যালারি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা শিশু কিশোরদের সেক্যুলার হয়ে উঠতে সাহায্য করেনা, বরং এখানের শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের লোভী হয়ে উঠতে শেখায়। দেশে প্রান্তিক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে লাইব্রেরীর সংখ্যা অপ্রতুল। বাংলাদেশে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা ফ্রী হলেও এরপর এই পঞ্চম শ্রেণী পাশ জনগোষ্ঠী কি করবে সেটা নিয়ে রাষ্ট্রের আদৌ মাথা ব্যাথা নেই। অথচ যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে লাইব্রেরীর পৃষ্ঠপোষকতা থাকতো তাহলে এই পঞ্চম শ্রেণী পাশ জনগোষ্ঠী সেক্যুলারিজমের প্রাথমিক শিক্ষাটা অন্তত পেতো। অবশ্য, রাষ্ট্র যদি সেসব লাইব্রেরীতেও সেন্সরশিপ আরোপ করে, যেমন কি ধরণের বই রাখা যাবে কী যাবেনা, তাহলে ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে রাষ্ট্র নিজেই জংগী জনগোষ্ঠী তৈরী করছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও ধর্মীয় শিক্ষা বিলোপ করা সেক্যুলার রাষ্ট্র হয়ে ওঠার আরেকটি ধাপ। আগেই বলেছি, সেক্যুলারিজম একটি চর্চা যা একদিনে সম্ভবপর হবেনা। রাষ্ট্র যদি একদিন ঘুম থেকে উঠে ঘোষণা দেয়, “আজকে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা বিলুপ্তি করা হলো।” তাহলে পরদিন সংঘাতের আশঙ্কা থেকে যায়।

দেশে নবম-দশম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা চালু আছে, যেটাকে রাষ্ট্র কৌশলী হয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে। আপনি কি কখনও খেয়াল করে দেখেছেন ধর্ম ক্লাসগুলোতে হিন্দু কিংবা অন্যান্য ধর্মের ছেলেগুলো আলাদা হয়ে অন্য কোন শ্রেণীকক্ষে চলে যায়। বিষয়টা অনেকটা বেদনাবহ দৃশ্যের অবতারণা করে। মুসলিম ছেলেটি তখন বুঝতে পারে তারা আলাদা ধর্মের, এভাবে ধীরে ধীরে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ তৈরী হয়। দেখা গেছে সকল কিছুতে দুজন একমত হলেও, ধর্মের প্রসঙ্গে দুজনের মতবিরোধ তীব্র হয়, যেটা পরবর্তীতে উগ্রতায় পরিণত হয়।

পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা নাহয় রাষ্ট্র সীমাবদ্ধ করে দিলো, কিন্তু এতেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হয়ে যায়না। দেখা যায় স্কুলে ক্লাস শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গাওয়ার চর্চার পাশাপাশি কোরান, গীতা, ইত্যাদি পাঠ করা হয়। রাষ্ট্র যদি সত্যিকার অর্থেই সেক্যুলার হতে চায় তাহলে এই ব্যাপারটিও নিশ্চিত করতে হবে যে, “ধর্ম যেহেতু যার যার ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলের মধ্যে, সুতরাং ধর্মীয় শিক্ষাও যার যার পরিবারের মধ্যে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই ধর্মীয় শিক্ষার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার।”

সেক্যুলার হবার ইচ্ছায় রাষ্ট্র যদি ঠিক এইভাবে গোড়া থেকে সংশোধন শুরু করতে পারে তাহলে পরবর্তীতে শিক্ষিত এবং আক্ষরিক অর্থেই উদার জনগোষ্ঠী বের হবে। যাদেরকে নিয়ে রাষ্ট্র সেক্যুলারিজম চর্চার পরবর্তী ধাপ শুরু করতে পারে। যে ধাপে কোন মন্ত্রী বিসমিল্লাহ বলে রাষ্ট্রীয় কাজ শুরু করবেন না, যে ধাপে বাংলা একাডেমির পরিচালক স্রেফ তার গা গুলিয়ে উঠেছে বলে লেখক – প্রকাশককে পুলিশের হাতে তুলে দেবেন না। যে ধাপে সম্মানিত ব্যক্তি কোন বিশেষ বই না পড়ার ব্যাপারে অনুরোধ করবেন না।

এখন দেখার বিষয় বাংলাদেশ কবে নাগাদ সেক্যুলার রাষ্ট্র হতে পারবে? আজ থেকে ২০/৫০/১০০ বছর? নাকি এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে চলতে একসময় বাংলাস্তানে পরিণত হবে!?