এএসপি আনিসুল করিম শিপন হত্যা ও বাংলাদেশ পুলিশের মানসিক স্বাস্থ্য

বাংলাদেশ পুলিশের (এএসপি) আনিসুল করিম শিপনকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে হত্যা করা হয়েছে। একজন পুলিশ অফিসারের হত্যা অবশ্যই এলারমিং কিন্তু এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে সচেতন ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তা হল উনি´মানসিক`চিকিৎসাধীন ছিলেন।

0
310

বাংলাদেশ পুলিশের (এএসপি) আনিসুল করিম শিপনকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে হত্যা করা হয়েছে। এএসপি আনিসুল করিম এর মত একজন পুলিশ অফিসারের হত্যা অবশ্যই এলারমিং কিন্তু এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে সচেতন ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। তা হল উনি´মানসিক`চিকিৎসাধীন ছিলেন।

স্বভাবতই কিছু  প্রশ্ন জাগে,

  • কেন একজন  গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মানসিক ভাবে এত দুর্বল হয়ে গেলেন, যে তিনি তার মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেছিলেন ?
  • বাংলাদেশ পুলিশের জন্য মানসিক চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা কি আছে ? যদি থাকে তাহলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেন আনিসুল করিম কে চিকিৎসা করানো হচ্ছিল ?
  • এই ক্লিনিকের কর্মীরা নিশ্চই তার পরিচয় জানতেন। জানার পরেও কীভাবে তাকে মারধোর করার সাহস পেল ?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করছি, মামলার এজাহারে বাদী আনিসুল করিমের বাবা  বলেন,

‘আমার ছেলে আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের একজন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার। আমার ছেলে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) হিসেবে কর্মরত ছিল। গত তিন-চার দিন যাবত হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে যায়। তাই তাকে মানসিক  চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাই।

অন্যদিকে গণমাধ্যমগুলো বলছে,

পদোন্নতি না পাওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন তিনি।

ধরে নিচ্ছি এই দুটো তথ্য ই সঠিক। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটাও সত্যি যে,  পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য না হারালে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে তার পরিবার মানসিক হসপিটালে ভর্তি করায় না, কিংবা করানোর কথা ভাবে না। এর সাথে তাদের সামাজিক মানসম্মান জড়িত বলে তারা মানসিক সমস্যাকে সজ্ঞানেই দৃষ্টিগোচর করেন।

আর একদিন হুট করেই কেউ মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলে না। তাই নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি, শুধু মাত্র একটা কারনেই আনিসুল হুট করে মানসিক স্থিতি হারাননি। এক্ষেত্রে অনেকদিনের অনেকগুলো ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি তার মানসিক ভাঙ্গনের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছেন। কর্মক্ষেত্রে কিংবা ব্যক্তিজীবনে নিশ্চই তিনি নানা সমস্যার সম্মুখীন ছিলেন। প্রশাসনিক দায়িত্বের বোঝা তিনি হয়ত আর বইতে পারছিলেন না। কিংবা দায়িত্ব পালন করার পরেও এর স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন না। তিনি হয়ত এই চাকরির ছাঁচের মত করে নিজেকে বানাতেই পারেননি, তার কাছে এই সোনার হরিণ হয়ত গলার ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সামাজিক, প্রশাসনিক, পারিবারিক চাপে সেই কথা উনি বলতে পারেননি। অথবা ব্যক্তি জীবনে হয়ত এমন অনেক কিছু ঘটেছিল, যা তার মানসিক বাঁধ দুর্বল করে ফেলেছিল। তাই কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি না পাওয়াটা তার বহুদিনের জমে ওঠা মানসিক সমস্যাগুলো কে ট্রিগার করে, বাঁধ ভেঙে দিয়েছে।

সে কথা হয়ত তিনি বলার চেষ্টা করেছেন কিন্তু বিষয়টি ওনার পরিবার  এবং  চারপাশের মানুষ দেখেও দেখেনি। যেহেতু উনি একজন গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ কর্মকর্তা তাই এদেশের ৯০ ভাগ মানুষের ধারণা ওনার কিংবা ওনাদের কোন মানসিক সমস্যা হতেই পারে না আর হলেও সেটা জানাজানি হলে প্রশাসনের, ওনার পরিবারের, বন্ধুদের  সম্মান চলে যাবে। মানুষের চেয়ে ওনার পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয়টাই মুখ্য ছিল।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল, বাংলাদেশ পুলিশের জন্য মানসিক চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা কি আছে ? যদি থাকে তাহলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেন আনিসুল করিম কে চিকিৎসা করানো হচ্ছিল  ?

গনমাধ্যমে এর উত্তর মেলেনি। ব্যক্তিগত ভাবে আমার পরিচিত পুলিশ বন্ধুদের কাছ থেকে জেনেছি, পুলিশ মহলে এটা বড় ধরণের ট্যাবু। এই বিষয় কিছু বের হলে পদোন্নতি বন্ধ হওয়া থেকে শুরু করে চাকরি চলে যাবার মত কারন ঘটতে পারে বিধায়, মানসিক সমস্যার বিষয়টা খুব গোপন রাখা হয়। আর পুলিশ প্রশাসনের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার তেমন কোন কঠোর নিয়ম অনুসরণ করা হয় না।

এক্ষেত্রে ধরে নিচ্ছি মানসিক সমস্যাগুলো নিয়ে তারা খুব গোপনে কাজ করে বলেই সংবাদ মাধ্যমে কিছুই আসে না। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশ পুলিশের জন্য মানসিক চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা থাকলে কেন আনিসুল করিম কে পারিবারিক ভাবে চিকিৎসা করানো হচ্ছিল? আর যদি পুলিশ প্রশাসনের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পরিক্ষার কঠোর নিয়ম থেকে থাকে, তবে তা কেন মানা হল না? সেক্ষেত্রে বলা যায়, এই পুরো প্রক্রিয়াটাই ত্রুটি পূর্ণ নইলে আনিসুল করিমের মানসিক সমস্যার সমাধান তো শুরুতেই হবার কথা। যেহেতু সেটা হয় নি তাই, পুলিশ প্রশাসনের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রক্রিয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এর কার্যক্রম শতভাগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী। পিল খানার ঘটনা থেকে আমরা জানি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কারো মানসিক স্বাস্থ্য  বিঘ্নিত হলে দেশের কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে।

এবার আসি শেষ প্রশ্নে

এই মানসিক হসপিটালের কর্মীরা নিশ্চই আনিসুল করিমের পরিচয় জানতেন। জানার পরেও কীভাবে তাকে মারধোর করার সাহস পেল ?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বর্তমানে পুলিশের ইমেজ নিয়ে কথা বলতে হবে এবং দেশের  জনগণের কাছে পুলিশ এর অবস্থান কেমন, সেই বিষয়টি বোঝাও জরুরী। মাত্র কদিন আগেই মেজর সিনহা হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই, সিলেটে এসআই আকবরের হাতে খুন হয়ে গেল এক নিরীহ লোক। তার উপরে রোজ সংবাদ মাধ্যমের পাতায় পুলিশের নানা ধরণের অপকর্মের খবর দেখা যায়। এই সব খবরের নিচে মানুষের রাগ ক্ষোভ আর হতাশার চিত্র আজকাল খুবই সাধারণ ব্যাপার। মানুষ একদিকে পুলিশ প্রশাসনের উপরে বিরক্ত অন্য দিকে আইন এর প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। বিচার বিভাগ কে তারা অথর্ব হিসেবেই দেখছে। সেক্ষেত্রে বলাই যায়, একজন মানসিক ভাবে অসুস্থ পুলিশ অফিসার এর মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যবহার কে, হত্যাকারীরা পুলিশের দুর্ব্যবহার হিসেবেই নিয়েছে, তারা আনিসুল করিম কে একজন রোগী নয় বরং একজন পুলিশ হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের রাগ ক্ষোভ উগ্রে দিয়েছে।

হাসপাতাল থেকে পুলিশ যে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করেছে, সেখানে দেখা গেছে, আনিসুল করিমকে সাত জন ব্যক্তি ধরে টেনে-হিঁচড়ে একটি কক্ষে ঢুকাচ্ছে। এরপর তাকে ফেলে তিন জন তার পিঠের ওপরে, দুই জন পায়ের ওপরে এবং দুই জন হাত ধরে বেঁধে ফেলে। দুই জন কনুই দিয়ে তার পিঠ ও ঘাড়ে আঘাত করছে। মারধরের কয়েক সেকেন্ড পর অচেতন হয়ে পড়েন আনিসুল। তারপর তার মুখে পানি ছেটানো হয়, সে সময় মেঝেতে পানি দিয়ে কিছু একটা মুছতেও দেখা যায়। এর কিছুক্ষণ পর অ্যাপ্রন পরা দুই জন নারীকে তার বুকে পাম্প করতে দেখা যায়। পরে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। পুরো বিষয়টাই প্রচন্ড অমানবিক আচরণের সাক্ষ্য দেয়।

 

সমস্ত ঘটনাটা কে পুলিশ প্রশাসন একটি নিছক হত্যা কাণ্ড হিসেবে দেখবেন, নাকি ঘটনার উৎস, কারন এবং পরবর্তীতে এমন বর্বরতার শিকার যেন কেউ না হয়, সে জন্য পদক্ষেপ নেবেন, সে সিদ্ধান্ত তাদের। কিন্তু এই ঘটনাটা একটা বড় বিষয় নির্দেশ করে আর তা হল বাংলাদেশ পুলিশের  মানসিক স্বাস্থ্য এবং বর্তমান পুলিশ প্রশাসনের উপরে জনগণের আস্থা। বিষয়গুলো ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।