মেয়েদের সিক্সথ সেন্স ভালো: প্রশংসা , নাকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অভিশাপ?

0
81

এই যে এতদিন ধরে ভেবে এসেছেন- মেয়েরা বিপদ বোঝে, তারা পুরুষের চোখ দেখলে বুঝে ফেলে মনের কথা, এটা তাদের গুণ। আসলেই কি তাই?

বলা হয়ে থাকে মেয়েরা বিপদ আগে থেকে টের পায় কিংবা মেয়েদের সিক্স্থ সেন্স অনেক প্রবল, কিংবা মেয়েরা বদ পুরুষের হাব-ভাব বুঝতে পারে- ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে প্রশ্ন হলো- কেন পারে? একই পরিবারে একই পরিবেশে বড় হওয়া একটা ছেলে থেকে একটা মেয়ের মধ্যে বিপদ আগে থেকে টের পাওয়ার ক্ষমতা কেন বেশি হয়?

প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ধারার ফেমিনিজম পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী-পুরুষের দৃশ্যমান বৈষম্যগুলোর দিকেই দৃষ্টি দিয়েছে। কিন্তু চতুর্থ ধারায় ফেমিনিজম আসলে অনেক বেশি সাইকোলজিক্যাল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেড়ে ওঠা নারীদের শারীরিক ক্ষতিগুলো দৃশ্যমান হলেও মানসিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়নি এতদিন। চতুর্থ ধারার ফেমিনিজম এই বিষয়গুলোকেই সামনে এনেছে।

বিষয়টা বুঝিয়ে বলি। ঢাকার রাস্তায় রাত ১২টার সময় একটা ছেলে বাইরে যেতে ভয় পাবে, কারণ ছিনতাই হতে পারে, একটা গাড়ি তাকে চাপা দিতে পারে, কেউ তাকে খুন করে ফেলতে পারে। কিন্তু একটা মেয়ে রাত ১২টায় একা বাইরে যেতে চাইবে না, তার কারণ সে জানে তার কোনো বিপদ হলে প্রথমেই তাকে প্রশ্ন করা হবে, এত রাতে কেন সে বাইরে ছিল? সে সেক্সচুয়ালি অ্যাবিউসড হলে প্রশ্ন করা হবে, সে কোন পোশাক পরেছিল, একা কেন সেখানে গেছে, তার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে, তাকে মন্দ মেয়ে বানিয়ে ক্রাইমটাকে জাস্টিফাই করা হবে।

অথচ কোন ছেলের সাথে ক্রাইম হলে এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন কিংবা এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ছেলেটাকে যেতে হয় না। তাই বিপদের ঝুঁকি গুরুত্ব না দিয়ে, ছেলেরা রাত বিরাতে বাইরে যায়। আড্ডাবাজি তথা সোশ্যালাইজ করে। এটা তাদের স্বাভাবিক জীবনের অংশ।

আমাদের দেশের হিসাব বাদ দিলাম, খোদ ওয়াশিংটনে সিয়াটেলের অধিবাসীদের উপরে করা একটা রিসার্চ অনুযায়ী, ৪২ ভাগ মেয়ে শুধু বিপদে পড়তে পারে জেনে নিজেকে সোশ্যালাইজ করা করা থেকে বিরত রাখে, যেখানে ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ৯ ভাগ!

যেখানে মেয়েরা বিপদের ভয়ে সোশ্যালাইজ-ই করে না, সেখানে তার সিক্সথ সেন্স ভাল, বিপদ আগেই টের পায়, অনেক বেশি ম্যাচিউর ইত্যাদি বলে আসল সমস্যাটা পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু না ।

‘নারীরা বাইরে নিরাপদ না’ এই কনসেপ্টটাই আসলে একটা অপকারী কনসেপ্ট। আমাদের মাইন্ড সেটটা এমন হয়ে গেছে যে, মেয়েরা বাইরে গেলেই অ্যাবিউস হবে তাই তাদের পাবলিক এক্সেস যত কম, তারা তত নিরাপদ, অথচ স্ট্যাটিস্টিক অনুযায়ী মেয়েরা ঘরে এবং পরিচিত মানুষ দ্বারাই অ্যাবিউস বেশি হয়। তাহলে মেয়েদের সিক্সথ সেন্স কিংবা বিপদ বোঝার ক্ষমতা আসলে কী কাজে লাগে!

এই যে এতদিন ধরে ভেবে এসেছেন মেয়েরা বিপদ বোঝে, তারা পুরুষের চোখ দেখলে বুঝে ফেলে মনের কথা, এটা তাদের গুণ, অথচ আজকে জানছেন যে মেয়েরা বোঝে কারণ তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করে। এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করার কুফল!

মাথায় কি জট পাকিয়ে গেছে? গেলেও সমস্যা নাই, কারণ হল এই বিষয় আমাকে বুঝতে, রাইট এমাউন্ট অফ প্যানিক: হাউ ওমেন ট্রেড ফ্রিডম ফর সেফটিমি টু এন্ড দ্য পলিটিক্স অফ সোশ্যাল চেইঞ্জ, গার্ল ট্রাবল: প্যানিক এন্ড প্রগ্রেস ইন দ্য হিস্ট্রি অফ ইয়ং ওমেন এবং কতগুলা জার্নাল পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। জট খুলতে রেফারেন্স দিলাম, পড়ে দেখবেন।

যাই হোক প্রসঙ্গে ফিরি। এই যে মেয়েদের বিপদ বোঝার ক্ষমতা টাইপ ধারণা হলো ছোটবেলা থেকে তারা যে জঘন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে, তার প্রতিফলন। এই প্রক্রিয়ার ভেতরে বড় হওয়া মেয়েদের মানসিক বিকাশ রুদ্ধ হয়েছে আর এখানে তার মানসিক ক্ষতি দৃশ্যমান তখনই হয়, যখন সে ছেলে দেখলেই অতিরিক্ত সতর্ক হয়, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে উঠতে ভয় পায়, নির্জন রাস্তা দেখলে তার হাত-পা ঠাণ্ডা হতে শুরু করে, কোন অপরিচিত পুরুষ তার দিকে তাকালে সে আঁতকে ওঠে। বাসার বাইরে যেতে অস্বস্তি বোধ করে- ইত্যাদি মানসিক ট্রমা।

একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শুধু মেয়েদের অর্থনৈতিক, শারীরিক, সামাজিক বৈষম্যই দেয় না, সেই সাথে তার মানসিক স্বাভাবিক বিকাশের পথ বন্ধ করে দেয়। আর এই বিষয়টাই হলো মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য।

এখন প্রশ্ন হলো এই বৈষম্য দূর করতে চতুর্থ ধারার ফেমিনিজম কীভাবে কাজ করছে?

এর একটা ভাল উদাহরণ আমাদের পাশের দেশ ভারতেই আছে। মুম্বাইয়ে কিছু মেয়ে মিলে #WhyLoiter মুভমেন্টটা শুরু করেছিল। কোন কারণ ছাড়াই ছেলেদের মতো রাতে-বিরাতে বাসার বাইরে আড্ডা দেয়া, চা খাওয়া, কিংবা স্রেফ সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে তারা চেষ্টা করেছিল যে ‘মেয়েদের রাতে বাইরে যাওয়া যাবে না’ টাইপ ট্যাবু কিংবা ভয় ভাঙতে এবং বর্তমানে এটা যথেষ্ট বড় মুভমেন্ট হয়ে গেছে। মি টু মুভমেন্টের কথা পাড়ার অশিক্ষিত লোকটাও জানে, তাই এটা নিয়ে বলার কিছু নাই।

আপনার বোঝার সময় এসেছে, যে মেয়েদের সিক্সথ সেন্স ভাল কিংবা তারা অল্প বয়সে ম্যাচিউর হয় ভাবা আসলে কমপ্লিমেন্ট না। তাদেরকে খুব অল্প বয়স থেকেই নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য স্ট্রাগল করতে হয়, যেটা একটা ছেলের করা লাগে না। আর এই কারণে মেয়েরা সব সময় সতর্ক থাকে। যেমন খাঁচার ভেতরে একটা বাঘকে রোজ পেটালে সে লাঠি দেখলেই ভয়ে সরে যাবে- এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এটা তাঁর ম্যাচিউরিটি না। তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর স্বাভাবিক স্বভাব কেড়ে নেবার প্রক্রিয়া।