মেয়েদের পিরিয়ড নিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে যেমন- এশিয়া, আফ্রিকা, এমনকি ইউরোপে ও ধর্মীয় গোঁড়ামিপূর্ণ অঞ্চলে বিবিধ কুসংস্কার, অজ্ঞতা এবং লৈঙ্গিক রাজনীতি চলছে সুদুর অতীত থেকে। পিরিয়ড বা মাসিকচক্র মেয়েদের প্রতিমাসের প্রাকৃতিক এবং নৈমিত্তিক জৈবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এই বিষয়ে হয়ত অনেকেই জানি না পৃথিবীর নানা স্থানে মেয়েরা মাসিকের সময় কীরকম অজ্ঞতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। অর্থ এবং যোগানের অভাবে অনেকেই স্যানিটারি প্যাডের বদলে পুরনো ছেঁড়া কাপড়, তুলা ইত্যাদি ব্যবহার করে যা তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
পবিত্রতার নামে তাদের উপর চলে কত ভয়ানক মানসিক অত্যাচার এবং শারীরিক অনাচার, ধর্মীয় রীতির নামে পীড়ন। কুসংস্কারগুলো সমাজের প্রতিটি স্তরে এমনভাবে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে যে, অত্যাচারকে মনে হয় শুদ্ধাচার। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশ, আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে মেয়েদের মাসিকের সময়টা যন্ত্রনায় পরিণত হয়। তাদের যন্ত্রণা লাঘব বা কুসংস্কার দূরীকরণে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তোলা এখনি প্রয়োজন। কয়েকটি উদাহরণের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারবো মাসিক নিয়ে সমাজে কত কত মিথ প্রচলন রয়েছে।
মাসিক নিয়ে বহুল প্রচলিত মিথের একটা হলো এই সময় মেয়েরা দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। নেপালে মাসিকের সময় মেয়েদেরকে বাধ্য হয়ে বাড়ির বাইরে একটা কুড়ে ঘরে বাস করতে হয় নেপালি ভাষায় যাকে বলে “ছুয়াপদি”।
মাসিক হলে মেয়েরা অশুচি হয়ে যায়। এই সময়ে তারা কোন ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এমনকি রান্নাঘরে প্রবেশও তাদের জন্য নিষেধ। মাসিক নিয়ে দেশে বিভিন্ন অপপ্রচার বহাল তবিয়তে বিদ্যমান যেমন আমাদের দেশে মাসিক চলাকালীন মেয়েদের স্পর্শে বানানো কাসুন্দি, ডালের বড়ি , আচার নষ্ট হয়ে যায়। জার্মানিতে মাখন নাকি ঘন হয় না, ফ্রান্সে মেয়নিজে স্বাদ পাওয়া যায় না, ইটালিতে ময়দা দলা বাঁধে না। কিন্তু বিজ্ঞানীগণ বলছেন ঋতুবতী মেয়ের স্পর্শে খাবারের স্বাদের কোন তারতম্য হয় না। রান্না যেকোন ব্যক্তি ব্যক্তিগত দক্ষতা যার সাথে মাসিকের কোন সম্পর্ক নাই।
মাসিকের সময় মেয়েরা অপরিষ্কার হয়ে যায় ফলে শাস্ত্রে তাদের মন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু এটা শুধুই কুসংস্কার ধর্মীয় এবং লিঙ্গ ভিত্তিক রাজনৈতিক অপকৌশল। বাস্তবতা হলো মানুষের অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপের মত মাসিকও একটা স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া এবং মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করলে শরীর অপরিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
অর্থনৈতিকভাবে সফল এবং শিক্ষিত পরিবার বাদে সবাই মাসিকের সময় মেয়েদেরকে খাটের উপর বিছানায় ঘুমাতে দেয় না যদি বিছানায় রক্ত লেগে যায় সেই আশংকায়। ভারত, বাংলাদেশ নেপালের কিছু অঞ্চলে মাসিকের সময় মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে আলাদা একটা স্থানে একাকী থাকতে দেয়া হয়।
মাসিকের সময় মেয়েদের পুকুর, জলাশয়, নদীতে স্নান করতে নামা নিষেধ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বিশ্বাস এতে পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে। তখন মেয়েরা পরিবারের সবার রান্নায়
অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু বিজ্ঞানীগণ প্রমাণ করে দেখিয়েছেন মাসিকের রক্তের মধ্যে বিষাক্ত কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমাদের দেশে কোন কোন অঞ্চলে মেয়েদের প্রথম মাসিক হলে তাদের আমিষ জাতীয় খাবার (মাছ, মাংশ) খাওয়া বাদ। নিরামিষ খেলে নাকি পেটে ব্যথা হয় না। আমাদের আগের প্রজন্মের মা-দাদীদের ধারণা মাছ মাংশ খেলে মাসিকের সময় দুর্গন্ধ হয়। আফগানিস্তানেও মাসিকের সময় মাংশ, ভাত, টকজাতীয় খাবার, ঠাণ্ডা পানি খাওয়া নিষেধ। তাদের মাটিতে বসা এবং গোসল করা বারন। আফগান সমাজে মাসিকের সময় মেয়েরা নোংরা হয়ে যায় এমনকি তাদের সাথে কথা বলা যাবে না।
অনেক দেশের মেয়েরা প্রথম মাসিকের আগে পর্যন্ত জানতেও পারে না মাসিক সম্পর্কে, এতটাই রক্ষণশীল সেখানের পরিবেশ। এশিয়ার কিছু দেশে স্যানিটারি প্যাড করাকে যৌনতা হিসেবে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। কোন নারী প্যাড ব্যবহার করে শুনে তার চরিত্রে লেপা হচ্ছে কলংকের দাগ, সমালোচনার কালি। কম্বোডিয়াতে মানুষের মাঝে প্রচার আছে, মাসিকের সময় প্যাড ব্যবহার করলে মেয়েদের কৌমার্য নষ্ট হয়ে যায়।
দক্ষিণ কোরিয়ার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রেনা পার্ক বলছেন, “কোরিয়ান সমাজের কিছু মানুষের বিশ্বাস স্যানিটারি প্যাড কোম্পানি তাদের ব্যবসার প্রচার প্রসারের জন্য মাসিক নিয়ে মিথ বানিয়েছে। বাজারে ব্যবসা করার জন্য তারা মেয়েদের কৌমার্য ও সতীত্ব নষ্ট করার জন্য।”
রোমানিয়াতে মাসিকের সময় ফুল ধরা নিষেধ। এতে নাকি কিছুক্ষণের মধ্যে মরে ঝরে যায়। পাকিস্তানে মাসিকের সময় বাথটাবে গোসল করলে তাদের মাংশপেশিতে টান লাগে। কিন্তু মেনস্ট্রুয়েশন হেলথ বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েলা কেইসার বলছেন মাসিকের সময় কুসুম গরম পানিতে গোসল করলে তাদের অস্বস্তি কিছুটা লাঘব হয়।
পৃথিবীর বিরাট অংশের মানুষ এখনো রয়ে গেছে কুসংস্কার এবং অজ্ঞতার অন্ধকারে। সেখানের মানুষ সচেতনতা তৈরি করতে পারেনি। যেমন ইন্দোনেশিয়ার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কিশোরী বলছেন,
“প্রথম মাসিকের রক্ত দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম, তবে কি আমার কোন অসুখ করল? মনে হয় আমার মাঝে কোন ঝামেলা হয়ে গেছে।”
মাসিকের মত স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়াকে একজন মেয়ের কাছে ট্যাবু হিসেবে মনে হয় প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় একজন অসচেতন মা যিনি নিজের অজান্তে বা সামাজিক প্রথার বৃত্তে টেনে নিয়ে যান নিজের মেয়েকে। এমনকি মেয়েটিকে নিষেধ করে দেয় নিজের বাবা, ভাইয়ের কাছে না যেতে।