ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যার প্রথম শিকার হয় জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল

জগন্নাথ হলের গণহত্যা

1
89
জগন্নাথ হলের গণহত্যা

 

ভাষা আন্দোলন সহ সকল প্রকার আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের সূতিকার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ৫২-এ ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এ স্বাধীনতার যুদ্ধে যেমন অংশগ্রহণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তেমনি ৭১-এ গণহত্যার শিকার হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীবৃন্দ।

৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যার প্রথম শিকার হয় জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)।

বেশ কয়েকটি কারণে জগন্নাথ হল ছিল পাকিস্তানী সেনাদের প্রথম টার্গেট। তপন বর্ধনের (জগন্নাথ হল গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী) মুখেই শুনি সেই কারণ-

মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠকে কোনরূপ অগ্রগতি না হলে উগ্র জাতীয়তাবাদী ছাত্ররা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান দিয়ে জঙ্গি মিছিল বের করে। জগন্নাথ হলের মাঠে ছাত্রলীগের অতি-উৎসাহী স্বেচ্ছা-সেবকরা গেরিলা যুদ্ধের মহড়া দিতে শুরু করে। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে সর্বত্র বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সৈনিকরা পল্টন ময়দানে গেরিলা যুদ্ধের মহড়া দেয়। সেখানে ছাত্রলীগের এক প্লাটুন গেরিলাও অংশগ্রহণ করে ছাত্রলীগ নেতা চিশতী শাহ হেলালুর রহমান এর নেতৃত্বে। যিনি ২৫শে মার্চ রাতে জহুরুল হক হলে শহিদ হন।

৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর অনেক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে চলে যায়। কেবল কিছু রাজনৈতিক কর্মী এবং যারা প্রাইভেট ছাড়তে নারাজ এমন ছাত্র হলে থেকে যায়। জগন্নাথ হল গণহত্যার শিকার শুধু ছাত্ররাই হয়নি শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা।

 

জগন্নাথ হলে মাটিতে মিশে আছে জ্যোতিময় গুহ ঠাকুরতা (যাঁকে চিত করে শুইয়ে গলায় গুলি করা হয়), মানবতাবাদী দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, বিদগ্ধ পণ্ডিত মুনীরুজ্জামান, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, মধু দা (মধুর ক্যান্টিনের মালিক), ছাত্র, কর্মচারী, শিববাড়ির গৈরিক বসনধারী কয়েকজন সাধু ও টুপি পরিহিত জনৈক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের রক্ত। এছাড়াও শিববাড়ির ৫ জন সাধুকে ধরে এসে জগন্নাথ হলের মাঠে হত্যা করা হয়েছে।

অধ্যাপক নূরুল উল্লাহর Bangladesh Genocide: Dhaka University Massacre ভিডিওতে জগন্নাথ হলের গণহত্যার নিষ্ঠুর চিত্রের দেখা মেলে। এছাড়াও আগ্রহীরা অধ্যাপক ড. নুরুল উল্লাহর সাক্ষাতকার পড়তে পারেন। লিংক-এখানে এছাড়াও গণহত্যার ছবি – ড. নূরুল উলা লিংক এখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষ্টুরতম গণহত্যার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন রতল লাল চক্রবর্তী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এবং পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যাঃ ১৯৭১, জগন্নাথ হল নামে বই সংকলন ও সম্পাদনা করেন। বইটিতে প্রত্যক্ষ ও গণহত্যা থেকে ভাগ্যজোরে বেঁচে যাওয়া মানুষের সাক্ষাৎকার দলিলপত্রের আলোকচিত্র, গণহত্যার চিত্র স্থান পায়।

২৫শে মার্চ রাতে জগন্নাথ হলের বেশির ভাগ ছাত্ররা যখন ঘুমিয়ে ছিল ঠিক তখন পাকিস্তান সৈন্যরা জগন্নাথ হলে অপারেশন শুরু করে।

প্রথমে গুলির শব্দ অতঃপর বোমা, ট্যাংকের শব্দে ছাত্রদের ঘুম ভেঙে যায়। প্রথম দিকে অনেকে ভাবছিল মুহসীন হল ও সূর্যসেন হলের ছেলেরা অস্ত্রের ট্রেনিং নিচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারল পাকিস্তান সৈন্যরা হল আক্রমণ করেছে। প্রাণ ভয়ে অনেকে ছাদে কেউ বা হল ছেড়ে পালাতে চাইল। কিন্তু পাকিস্তান সৈন্যদের হাত থেকে খুব কম সংখ্যক ছাত্রই রেহাই পায়।

 

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী হলের কক্ষ শুধু নয় হলের টয়লেটগুলো কসাই খানায় তৈরি হয়। অনেক ছাত্রকে হলের ছাদ থেকে গুলি করে পুকুরে ফেলে দেয় পাকিস্তান সৈন্যরা। টিক্কা খানের সৈন্যদের নৃশংসতা কেমন হতে পারে তার আন্দাজ পাওয়া যায় টিক্কা খান কর্তৃক বেলুচিস্তানে ইদের জামাতের উপর বোম্বিং করার ঘটনা থেকেই। হলের ছাত্রদের খুঁজে পাওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তানী হিংস্র সৈন্যরা পৈশাচিক আনন্দে চিৎকার করে বলত-‘ওস্তাদ, চিড়িয়া মিল গিয়া’। জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থেকে প্রতিরোধ আসতে পারে। এই ভয়েই তারা মর্টার ও মেশিনগান ব্যবহার করে নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর।

রাতে হামলা হতে পারে অথবা পাকিস্তানী সৈন্যরা রাস্তায় নামবে এমন আন্দাজ সন্ধ্যা থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। আর সেই কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান বুয়েট) ছাত্ররা রাস্তায় বেরিক্যাট দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী পাকিস্তানী সৈন্যরা জগন্নাথ হলের কিছু ছাত্রকে সারিবদ্ধভাবে নিয়ে যাচ্ছিল আর বলছিল-“জয় বাংলা বাতাও”। শুষ্ক কণ্ঠে ক্ষীণ উচ্চারণে ছাত্ররা “জয় বাংলা” বলতে থাকে।

এছাড়াও ছাত্রদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর অনেক আহত ছাত্র চিৎকার করলে তাদের বেনট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পাকিস্তান সৈন্যরা। ছাত্রদের শারীরিক নির্যাতনের সময় জল্লাদরা বলত-”বাতাও জয়বাংলা, বানচোত, শেখ মুজিব কাঁহা গিয়ে?”

অনেক ছাত্র প্রাণ ভয়ে টয়লেটে গিয়ে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্যরা টয়টেল থেকে খুঁজে বের করে তাদের হত্যা করে। ভাগ্যজোরে কোন কোন ছাত্র বেঁচে যায়। আবার অনেক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও বেঁচে যায়। পাকিস্তান সৈন্যদের অভিযান চলে সকাল পর্যন্ত। হলের রুমগুলোতে পাকিস্তান সৈন্যরা আগুন ধরিয়ে দেয়। সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর অনেক উর্দুভাষী (বিহারী) হলে লুটপাট চালায়। বিহারীরা লুটপাট চালিয়েছিল তা যেমন সত্য তেমনি জগন্নাথ হলের কয়েকজন ছাত্র কিছু বিহারীর বাসায় আত্মগোপন করে প্রাণে বেঁচে যায় তাও সত্য। রাত বারোটার পর থেকে পাকিস্তান সৈন্যরা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। ফজরের আজানের সময় পাকিস্তানী সৈন্যদের নৃশংসতা কিছুটা কমবে বলে জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্র আশা করছিল কিন্তু অবাক বিষয় হল ঐ সময় বরং তাদের নৃশংসতার তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়।

মার্চ মাসে জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সৈন্যদের গণহত্যা হয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য তখনও আমাদের দেশের কিছু পাকিস্তানপন্থী শিক্ষক ও বর্তমান বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী বেশ আরাম আয়েশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চালিয়ে গেছেন। ভাল মন্দ সবজায়গাতে থাকে। অনেক শিক্ষক যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে ছিলেন তেমনি অনেক শিক্ষক সরাসরি স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন কেউ বা স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন আদর্শিক কারণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী শিক্ষা সম্মেলনে দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন।

ইয়াহিয়া খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য সাজ্জাদ হোসেনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করেন। সাজ্জাদ হোসেন তার সহকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। বাঙালি জাতির কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধ্বংসের জন্যে তার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্যরা হলেন, ড. হাসান জামান, ড. মোহর আলী, এ এফ এম আব্দুর রহমান, আবদুল বারী, সাইফুদ্দিন জোয়ারদার এবং মকবুল হোসেন। সাজ্জাদ হোসেন ৪ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সেনাবাহিনীর কারণেই বহু শিক্ষকের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। এই হলো দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের উপাচার্যের ভূমিকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সাজ্জাদ হোসেনের ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলো শান্তি কমিটি। এই শান্তি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর ফখরুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। দেশের অবস্থা স্বাভাবিক দেখানোর জন্যে জোরপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় খোলা এবং ক্লাস নেয়ার জন্যে বাধ্য করা হয়। এতে সাজ্জাদ হোসেনকে সহায়তা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক। দেশের খ্যাতনামা ৫৫ জন শিক্ষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এক বিবৃতিতে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চরমপন্থি হিসেবে অভিহিত করেন। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এবং গণহত্যা কার্যক্রমের পক্ষে ২ এপ্রিল ঢাকা হাইকোর্টের ৩৯ জন আইনজীবী এক যুক্ত বিবৃতি প্রদান করেন। তারা পাকিস্তানের নগ্ন ও নৃশংস আক্রমণের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধকে ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ বলে প্রচারণা চালায়। একই ধরনের বিবৃতি দেয় ঢাকা জেলা বারের পঞ্চাশ-জন আইনজীবী। ৪ এপ্রিল নবাব হাসান আসকারীর নেতৃত্বে ঢাকার প্রখ্যাত সর্দাররা সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সব শিক্ষককে দালালীর অভিযোগে স্বাধীনতার পরে বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয় তারা হলেন : ১. আখতার ইমাম (প্রভোস্ট রোকেয়া হল), ২. ড. কাজী দীন মোহাম্মদ (বাংলা), ৩. মোস্তাফিজুর রহমান (আরবি), ৪. ফাতিমা সাদিক (আরবি), ৫. ড. জি ডবি্লউ চৌধুরী (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), ৬. ড. রাশিদুজ্জামান (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), ৭. এফ. এম. শহীদুল্লাহ (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), ৮. জামালউদ্দিন মোস্তফা (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), ৯. আফসার উদ্দিন (সমাজ বিজ্ঞান), ১০. মীর ফখরুজ্জামান (মনোবিজ্ঞান), ১১. ড. সামছুল ইসলাম (পদার্থবিদ্যা), ১২. ড. আঃ জব্বার (ফার্মেসী), ১৩. মাহবুব উদ্দিন আহমদ (পরিসংখ্যান),

১৪. আশকার ইবনে শাইখ (পরিসংখ্যান), ১৫. হাবিবুল্লাহ (শিক্ষা), ১৬. আঃ কাদের মিয়া (শিক্ষা), ১৭. শাফিয়া খাতুন (শিক্ষা), ১৮. লেঃ কঃ (অবঃ) মতিউর রহমান (স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ), ১৯. আতিকুজ্জামান খান (সাংবাদিকতা), ২০. ড. আফতাব আহমেদ সিদ্দিকী (উর্দু ও ফার্সি), ২১. ফজলুল কাদের (উর্দু ও ফার্সি), ২২. নূরুল মোমেন (আইন), ২৩. এস এম ইমামুদ্দিন (ইসলামের ইতিহাস), ২৪. মাহবুব আলম (উদ্ভিদ বিদ্যা), ২৫. ফাইজুল জালাল (উদ্ভিদ বিদ্যা)। (সূত্র : দৈনিক বাংলা ০১/১০/১৯৭৩ খ্রিঃ)।

এই জ্ঞানপাপী স্বাধীনতা বিরোধী দালাল শিক্ষকদের বিচারের আওতায় আনা অতি জরুরী একটি বিষয় ছিলো। কেনো তাদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি তার কারণ উদ্ঘাটিত হওয়া প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন দালাল শিক্ষকের অপরাধ আর গ্রামের একজন অশিক্ষিত চাকুরীর লোভে রাজাকার হওয়া নিশ্চয় একই রকম অপরাধ নয়। এছাড়াও ২৬শে মার্চ গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া অনেক শিক্ষক, যাদের ঢাকা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়েছে। নিয়মিত যারা ডিপার্টমেন্টে গেছেন তাদের মধ্যে-আহমদ শরীফ,সিইচৌ,বোরহান উদ্দিন খানজাহাঙ্গীর, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ছিলেন। অনেকে আবার সেখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে গেছেন।

২৫ মার্চের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রোষ পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ওপর। ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত এ স্থাপনা তারা গুঁড়িয়ে দেয়। জগন্নাথ হলে নির্মিত শহীদ মিনারও তাদের ক্রোধের শিকার হয়ে ধুলায় মিশে যায়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনের খোলা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে থাকা নিরীহ বট গাছটিও তাদের ক্রোধের শিকার হয়। বটগাছটির শিকড়-সুদ্ধ উপড়ে ফেলার সময় পাকিস্তানি সৈন্য ট্যাঙ্ক-সাঁজোয়া বহর নিয়ে হাজির ছিল। বট গাছটির উপর ক্রোধের কারণ;- এই বটবৃক্ষের ছায়ায় শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা অধিকারের কথা বলত, গণতন্ত্রের কথা বলত, মুক্তির কথা বলত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি যিনি মুক্তিযুদ্ধে চলাকালে পাকিস্তানীদের বর্বরতার বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের সপক্ষে সোচ্চার ছিলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে এসে নতুন একটি বটগাছ রোপণ করেন, যা এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এই বটতলায় একাত্তরের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিপুল উত্তোলন করে বাংলাদেশের পতাকা।

ডিসেম্বর মাস পাকিস্তানীদের পরাজয়ের মাস। ১৬ ডিসেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করে। সেনাবাহিনী তখন পরাজয়ের প্রহর গুনছে। মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি চালাচ্ছে তারা। জারি করা হয় কারফিউ। এ সময়েই আলবদররা পাকিস্তানী সৈন্যদের নিয়ে মুনীর চৌধরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুুরী, আনোয়ার পাশা, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বরেণ্য শিক্ষক এবং ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার, চিকিৎসক আলীম চৌধুরী ও ফজলে রাবি্বসহ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে রায়ের-বাজারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশকে মেধা-শূন্য করাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। দেশের আরও কয়েকটি স্থানেও চলে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ।

২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ চালুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার নোবেল বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু বলেছিলেন, গণহত্যা নিয়ে গবেষণা কেবল কিছু লোকের প্রতি বৈরী মনোভাব সৃষ্টির জন্য করা হয় না, বরং এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এ অন্যায় সম্পর্কে সচেতন করা হয়। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের কোথাও যেন এমন নারকীয়তা আর না ঘটে এবং তা করার ধৃষ্টতা কেউ না দেখায় সে শিক্ষা তুলে ধরা চাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্রদের যেমন গৌরবের ইতিহাস আছে তেমনি কিছু শিক্ষক ছাত্রের কর্মকাণ্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো অধ্যায় রচনা করে। যা আমরা বলতে চাই না। কিন্তু ইতিহাস কারোকে ক্ষমা করে না। আজকে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে তারা অনেকেই জানে না,৭১ সালের ২৫শে মার্চ কী হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরনো সেই যৌবন এখন আর নেই। আন্দোলনের সূতিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ শুধুই ‌ইতিহাস। টেন্ডার-বাজী ও সন্ত্রাসের ভিড়ে হারিয়ে গেছে ছাত্রদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া। তাই তো নিহত রাজু পাথর হয়ে আজো দাঁড়িয়ে থাকে টিএসসির চত্বরে। প্রতিবাদ আজ শাহবাগের টঙ দোকানে। আর সন্ত্রাস মৌলবাদে ছেয়ে গেছে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়টি।

কৃতজ্ঞতা-
রতল লাল চক্রবর্তী-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা-জগন্নাথ হল
হাসান আলী-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা বিরোধী পঁচিশ শিক্ষক
ইমতিয়াজ আহমেদ-গণহত্যার এপিসেন্টার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্য লেখা পড়তে ক্লিক করুন নারী রাজাকারদের ইতিহাস । কে বলে ৭১ এ নারী রাজাকার ছিল না ?

১ টি মন্তব্য

কমেন্ট বন্ধ করা হয়েছে